ঢাকা , বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫ , ১৫ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

কিশোর বয়সে মনস্তত্ত্বের বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে প্যারেন্টিং-এর ভূমিকা (১২-১৬ বছর পর্যন্ত)

সুখী ও সফল আগামীর জন্য প্যারেন্টিং গাইড (পর্ব – ৪)

মার্তৃভূমির খবর ডিজিটাল ডেস্ক
আপলোড সময় : ২৮-১০-২০২৪ ০৮:০৩:০০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৮-১০-২০২৪ ০৮:০৩:০০ অপরাহ্ন
সুখী ও সফল আগামীর জন্য প্যারেন্টিং গাইড (পর্ব – ৪) প্রতীকী ছবি

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ কিশোর বয়স (১২-১৬ বছর) হলো জীবনের একটি জটিল এবং অত্যন্ত সংবেদনশীল সময়কাল। এই সময়ে শিশুদের শরীর, মন ও আবেগের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। শারীরিক ও হরমোনাল পরিবর্তন, মানসিক বিকাশ এবং ব্যক্তিত্বের গঠন—সব কিছুই এই সময়ের মধ্যে ঘটে। এই সময়টা এমন, যখন একজন কিশোর বা কিশোরী তার নিজস্ব পরিচয় এবং স্বকীয়তা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। তারা নিজেদের ভাবনাগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখে এবং চারপাশের দুনিয়াটাকে বুঝতে শুরু করে।


এই বয়সে সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্যারেন্টিং খুবই জরুরি। কারণ এই সময়েই সন্তানের মানসিক বিকাশে প্যারেন্টিং-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। যদি বাবা-মা তাদের সন্তানদের সাথে মানসিকভাবে যুক্ত না থাকেন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে এবং মানসিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এই নিবন্ধে আমরা কিশোর বয়সে মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ এবং প্যারেন্টিং-এর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।


কিশোর বয়সে মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন
কিশোর বয়সে শিশুরা হরমোনাল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়, যার ফলে তাদের শরীর এবং মন উভয় দিকেই পরিবর্তন আসে। এ সময়ে শারীরিক পরিবর্তন যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি মানসিক ও আবেগিক পরিবর্তনও ঘটে। কিশোর-কিশোরীরা ধীরে ধীরে নিজেদের ব্যক্তিত্ব গঠন করতে শুরু করে। তারা নিজেদের চিন্তা-ভাবনার ওপর আত্মবিশ্বাস অর্জন করে এবং বাইরের জগতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। সমবয়সীদের সাথে বেশি সময় কাটানোর প্রবণতা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মানসিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
এই পরিবর্তনগুলো শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই সময়ে যদি বাবা-মা সঠিকভাবে সমর্থন না দেন বা সঠিক দিকনির্দেশনা না দেন, তাহলে শিশুরা বিভ্রান্ত হতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে। এ সময়ে বাবা-মায়ের ধৈর্য, বোঝাপড়া এবং সহমর্মিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


কিশোরদের চাহিদা ও সমসাময়িক সমস্যা
১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোর-কিশোরীরা মানসিক এবং আবেগগতভাবে পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। এই সময়ে তারা নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে। এ সময়ে নতুন নতুন ধারণা এবং চিন্তাধারা গড়ে ওঠে, যা তাদের আগের মতের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
এই বয়সে তারা অনেক সময় সমবয়সীদের প্রভাব এবং চাপের মুখোমুখি হয়। তারা প্রায়ই নিজেদের প্রমাণ করতে চাইতে পারে, যা তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করতে পারে। সমবয়সীদের চাপ থেকে বাঁচতে তারা এমন কিছু কাজ করতে পারে যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ফলে তাদের মধ্যে ভুল ধারণা জন্মাতে পারে, আর সে কারণে তাদের আচার-আচরণেও পরিবর্তন দেখা দেয়।


প্যারেন্টিং-এর ভূমিকা
এই সময়ে বাবা-মায়ের ধৈর্য এবং ভালোবাসামূলক প্যারেন্টিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিশোর-কিশোরীদের আবেগ এবং মানসিক অবস্থাকে সম্মান করা এবং তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করা, যাতে তারা নিজেদের নিরাপদ এবং সমর্থিত বোধ করে।
কিছু সফল প্যারেন্টিং কৌশল নিচে তুলে ধরা হলো:


১. ইতিবাচক সমর্থন প্রদান
কিশোর-কিশোরীদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হলো বাবা-মায়ের সমর্থন। সন্তানের সিদ্ধান্ত নিয়ে সব সময় সমালোচনা না করে, তাদেরকে ইতিবাচক দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। যখন তারা দেখে যে বাবা-মা তাদের পাশে আছেন এবং তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন দেখাচ্ছেন, তখন তারা আত্মবিশ্বাসী হয় এবং ভবিষ্যতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।


২. সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গড়ে তোলা
এই সময়ে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গড়ে ওঠে। বাবা-মায়ের উচিত তাদেরকে সঠিক তথ্য এবং জ্ঞান প্রদান করা, যাতে তারা নিজেরাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। যখন তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন তারা জীবনেও আরও সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।


৩. নৈতিক শিক্ষা প্রদান
নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ একজন ব্যক্তির জীবনের ভিত্তি। বাবা-মায়ের উচিত এই সময়ে সন্তানদের মধ্যে সততা, দায়িত্ববোধ এবং ন্যায়বিচারের শিক্ষা গড়ে তোলা। এই গুণগুলো তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে এবং ভবিষ্যতে তাদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।


৪. আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা
কিশোর বয়সে আবেগ অনেক তীব্র হতে পারে। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদেরকে শেখানো, কীভাবে তারা রাগ, হতাশা এবং উদ্বেগের মতো আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবেগের উপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ তাদের ভবিষ্যতে অনেক সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করবে।


৫. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো
বর্তমান সময়ে কিশোর-কিশোরীরা প্রযুক্তির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম—সবকিছুই তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বাবা-মায়ের উচিত তাদেরকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো এবং সময়মতো ব্যবহার করার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করা। অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।


২১ শতকের চ্যালেঞ্জ এবং কিশোরদের জীবন
কিশোরদের জীবনে ২১ শতকের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার, সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। একদিকে যেমন তারা বিশ্বব্যাপী জ্ঞান এবং তথ্যের সহজলভ্যতা পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার কিশোরদের মধ্যে আত্মমর্যাদা, মানসিক চাপ এবং অন্যদের সাথে তুলনার মতো সমস্যা তৈরি করে।


বাবা-মায়ের উচিত এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য তাদের সন্তানদের সাহায্য করা। সন্তানদের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব থেকে তাদের মুক্ত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানদের জীবনে নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ এবং মানসিক সুস্থতার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।


১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোর-কিশোরীরা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়। এই সময়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে, যা তাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাবা-মায়ের সহায়ক ভূমিকা এবং প্যারেন্টিং এই সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন।


যদি বাবা-মায়ের কাছ থেকে ইতিবাচক সমর্থন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা না পাওয়া যায়, তাহলে কিশোর-কিশোরীরা মানসিকভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে। সঠিক প্যারেন্টিং-এর মাধ্যমে তাদের জীবনের সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া সহজ হয় এবং তারা ভবিষ্যতে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। একটি সঠিক প্যারেন্টিং কৌশল কেবল সন্তানের জীবনেই প্রভাব ফেলে না, বরং সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।



 


নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ